বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

 

টাইট্‌ল সং – বই রিভিউ

স্তব্ধ চুম্বনের পাশে অপেক্ষা করে থাকে নতজানু নদীজল

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়




কবি অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতার ভেতর আমি সাঁতারের অসহজ ডিঙি খুঁজি না  ।কারণ তাঁর কবিতাকে পারাপার করার কোন অতিক্রম্য ইচ্ছে আমার  নেই । ডুব দিই , স্পর্শ করি  নিভৃত জলপদ্মের বৃন্ত , রঙিন মাছের ভেসে যাওয়া । স্থির উৎসবে শব্দের নুড়ির তীব্র কাঁপন অনুভব করি – “ একটি স্তব্ধ চুম্বনের পাশে অপেক্ষা করে থাকে নতজানু নদীজল ”। দেখি কীভাবে শব্দগুলি  না লেখা চিঠির গোপনীয়তায় অলৌকিক জাদুতে মায়াতে এবং তাঁর হাতের স্পর্শে  ক্লান্তি ও ক্লিষ্টতা থেকে মাথা তুলে গন্ধরাজ হয়ে যায় । হা ক্লান্ত অন্ধকার গুড়ো করে বিস্ময়াবিষ্ট কোন সন্ধ্যে ছাপিয়ে মোমবাতি জলে এবং অত্যন্ত  সন্তর্পনে তা আমাকে নিয়ে যায় নির্জন সমারোহের দিকে । শব্দকে হাতের মুঠোয় ভরে  নৈশব্দের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিতে জানেন অনিন্দিতা । একবার নয় বারবার তাঁর  ভাবনার গভীরে ডুব না দিলে তাঁর চিন্তাস্থাপত্যের দিকচিহ্নগুলি উদ্ধার করা যায়না ।

"শাবকগন্ধ চিনে  যে  পাখিটি ঘরমুখী তারও কোন ব্যাকরণ নেই ।"  এই স্নেহ এবং অপত্যপ্রীতি এলোমেলো ক্রিয়া , বিশেষণ এবং অব্যয় সমন্বিত শব্দের সমাকলন নয় ।কোন গাণিতিক ফর্মুলা বা গ্রামারের অনুশাসন দিয়ে কি বেঁধে রাখা যায় জৈবিক জ্যামিতির এই আশ্চর্য বুনন  ? ক্রমাগত তোলপাড় হতে থাকা হৃদয়ের ভেতরে অবনত ছায়াদের ঋজু হয়ে ওঠা ‘তুমি কার কতটুকু ?’ এই প্রশ্নের দায়ভার অমোঘ বলেই আলোর শরীর ভেঙে ছায়ার অভ্যুত্থান  ‘ তবুও সম্পর্ক শুধু  অমরতা দাবি করে অবুঝ আঁকড়ে ধরে উড়ো মেঘ ’ বৃষ্টিচ্ছায় এই দিনগুলির ভিতর গাঁথা হয় শব্দনিশান । আর অসমাপ্ত খেলাকে আড়াল করে জমে ওঠে ঋণ -   ‘সমস্ত অপ্রয়োজন  যতদূর ততদূর জাতীয় সড়ক’


       জীবন এবং জীবনের ভেতর যে অনিকেত অতিবেগুনী আলো রয়েছে সেই আভায় চলমান রাস্তা খুঁজে নেওয়া । নিজের অবস্থানকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখা , কখনও কখনও এই অবস্থানের  বক্রতা থেকে অসরলরৈখিক বেষ্টনীর অসহ আবদ্ধতা ছিড়ে কুচি কুচি করে  নিজের উজ্জ্বল পালক উড়িয়ে দেওয়া ।এই আবহমান সময়কে মন্থন করেই উঠে আসে অনিন্দিতার কবিতা । জলের কথা বারবার লিখেছেন অনিন্দিতা । বারবার বিভিন্ন আঙ্গিকে কখনও  তা চোখের কোল ছুঁয়ে  জমে  ওঠে কখনও তা প্রতিশ্রুতিহীন ভোরবেলার  শব্দে ডাকে অথবা ওপড়ানো শিকড়ের অনেক গভীরে নিস্তবদ্ধতায় জমতে থাকে । আর এভাবেই সঞ্চিত হতে হতে কৌশলে সরিয়ে নেয় সমস্ত  লবন , উল্টো স্রোতের মুখে স্পর্শটুকু  ফেলে রেখে  প্রলয়ের আবছাবিন্দু ছুঁয়ে ভেসে থাকে “ অবিশ্রান্ত ঢেউ এর নালিশ গড়িয়ে গড়িয়ে এসে ছুঁয়ে /  চলে গেছে ।খোলা পায়ে বালির আদর , একটানে অতল জলের দিকে ঠেলে দেয়  কোল দেয়  । চকিত চুমুতে লোনা জিভ । মৃতপ্রাণী  ফিরিয়ে দিয়েছে জল , আমাকে টেনেছে । টের পাই কী ভীষণ  বেঁচে আছি আজও । ” জল তো জীবনের কথাই বলে বেঁচে থাকার কথা  এবং আগামী জন্মের কথা  “ ঘুমন্ত জয়ায়ুর মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে মুঠি খুলবে একটা ভোর । জল ছোঁবে ”
                                              এই যে চারপাশের বাতিল জঞ্জাল , “সমস্ত জানলা বন্ধ হয়ে আসছে ”আর প্রতিদিন” মৃত্যুর  রিহার্সাল ঘুমের ভেতর’   যেখানে আমাদের “উচ্চাকাঙ্খী বেঁচে থাকাগুলো দু একটি ফ্যাকাশে নাসপাতি” এবং আপাত স্বচ্ছতায় রক্তহীন  সেই নীরক্তকরবীর ধ্বনিই তো অনিন্দিতা  অনুভব করেছেন –“কালশিটের  চিহ্ন ছাপিয়ে রোদ ধুলো গানমানচিত্র আঁকে অপমানিত দুগালের ওপর”  যেখানে শুধু জ্বালা – “এই শূন্য ছোঁয়া জলপথ । আর এই জ্বলে যাওয়া অক্ষিকোটরে কোন মেঘ নেই , ছায়াপথ নেই ”  এই অপমান আর যন্ত্রনার দিনলিপি থেকে আত্মহত্যার জবানবন্দী কিংবা অফেরতযোগ্য সব আক্ষেপলিপির আগ্রাসন থেকে  তিনি অতিক্রম করতে চেয়েছেন যাবতীয় ব্যথাপাহাড় । “অত্যাশ্চর্য নীরবতা ভেঙেচুরে যদি বেরিয়ে আসতো সেই জলস্রোত ” এ শুধু আকাঙ্ক্ষা নয়  এই সম্ভাবনার খুব কাছ দিয়ে মেঘ উড়ে চলে – “আয় বৃষ্টি আয় ঘুম আয় ঢেউ আর নৌকো । এসো জন্মান্তর ” এই জীবন আর ভালোবাসা আঠালো কুয়াশায়  নিটোল হয়ে ওঠে এবং প্রলম্বিত আলাপে বিস্তারে  টাইট্‌ল সং বাজতে থাকে গানবাড়ি থেকে । ডানার আড়ালে শস্যবীজ  নিয়ে উড়ে চলে আবহমান জীবন  যেখানে  স্তব্ধ চুম্বনের পাশে অপেক্ষা করে থাকে নদীজল , জীবন প্রবাহ । 

টাইটল সং ।।অনিন্দিতা গুপ্ত রায় ।। ৯য়া দশক ।। কলকাতা – ১০৮ ।। প্রচ্ছদ –তুষার সাহা ।। ৪০ টাকা ।।


 

3 comments:

  1. Ei sundar onuvober pashe thaklam....

    ReplyDelete
  2. কবি অনিন্দিতাকে তুমি ঠিকই ধরেছো বিপ্লব।

    ReplyDelete

Facebook Comments