শৌভ চট্টোপাধ্যায়

 

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা



যক্ষ



মহাভারত অনুসারে, যক্ষগণ আসলে দেবযোনি বা উপদেবতা—নর ও দেবতার মধ্যবর্তী সত্তা। যক্ষ, গন্ধর্ব ও রাক্ষসরা সমপর্যায়ভুক্ত। এঁরা স্বেচ্ছাবিহারী। সাধারণত এঁদের বিচরণ সন্ধ্যার পূর্ব থেকে সমগ্র রজনীভাগ। যক্ষদের রাজা হলেন কুবের। তিনি রাক্ষসদেরও অধিপতি এবং দেবতাদের ধনাগারের অধ্যক্ষ। এছাড়া, মণিভদ্র, ধনদ, শ্বেতভদ্র, ফলকক্ষ, হেমনেত্র, প্রবালক, হংসচূড়, পিঙ্গলা, পুষ্পানন প্রমুখ যক্ষের নাম মহাভারতে উল্লেখিত হয়েছে।

সাধারণ বিশ্বাসমতে, যক্ষগণ মানুষ, জীবজন্তু ও প্রকৃতির হিতৈষী। ধনসম্পত্তাদির রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষত ভূগর্ভস্থ বা বৃক্ষমূলে প্রোথিত সম্পদের রক্ষা, যক্ষদের প্রধান কর্তব্য।


১.


আসলে, কিছুই ঠিক হাসিল হল না। আরো কাজ, ঢের কাজ, বাকি রয়ে গেল। প্রাচীন কবালাগুলি, পরচাগুলি মহীধর খুঁটিয়ে দেখেন। বিস্মৃত মৌজার মধ্যে, তহশিলে, পত্তনির দাগে, আঙুল বুলিয়ে তিনি বুঝে নেন পুরোন হিসেব। হয়তো, এদের মধ্যে, বন্যায় বহু চর নিশ্চিহ্ন হয়েছে, জমি গেছে নদীর ভাঙনে। তবু এই হলুদ কাগজ ছুঁয়ে, মহীধর তৃপ্তি পান। মহীধর ভাবেন, তবে এই ছিল তালুকের সীমা! এই ছিল রণ-রক্ত-সফলতা, পুরুষের ঘাম!

হঠাৎ কলম খুলে, অধুনাবিলুপ্ত এক পৃথিবীর গায়ে, মহীধর এলোমেলো আঁচড় কাটেন।

২.


মহীধরও এককালে হিসেবী ছিলেন। রোজ রাতে আলো জ্বেলে সংসারের জমা ও খরচ, পাই-পয়সা গুণে-গেঁথে মিলিয়ে নিতেন। অথচ, এখন আর কিছুতেই হিসেব মেলে না। খরচের অঙ্ক বাড়ে প্রতিদিন। সঞ্চয় ক্রমশ এসে তলানিতে ঠেকে। দোকানীর সঙ্গে রোজ অহেতুক কলহে জড়ান। ভাবেন, মানুষ তাঁকে ঠকাবে বলেই, ওঁত পেতে বসে আছে। চোর বা খাতক ভেবে, মহীধর সবাইকে এড়িয়ে চলেন।

মনে মনে, তিনিও জানেন তাঁর অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে উৎপাদন, বিনিময়, মুদ্রার প্রথাও। জাল ক্রমে ছোট হচ্ছে। লম্ফের আলোয় তিনি স্বচক্ষে দেখেন—ভয়াল যক্ষের ছায়া ফুটে উঠছে ঘরের দেয়ালে।

৩.


বাইরে আওয়াজ হলে, মহীধর চমকে ওঠেন। লাঠি-হাতে, শশব্যস্তে ছুটে যান দরজার দিকে। সাবধানের মার নেই। তাছাড়া এখন, দিনকালও সুবিধের নয়—চারিদিকে লোকক্ষয়, রাহাজানি, প্রেতের প্রহার। তার মধ্যে, কে কখন ঢুকে পড়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে, বাগান তছনছ করে! মহীধর ভয় পান। লাঠি ঠুকে, অকারণে, চেঁচিয়ে ওঠেন।

মহীধর বুঝেছেন, ধ্বংস ছাড়া, আর কোনো নির্মাণই চিরস্থায়ী নয়। সামান্য ঘাসের শীষও, মানুষের হাতে, অসামান্য আয়ুধ হয়েছে। খড়খড়ির ভাঁজে, আলোর শুকিয়ে আসা রেখাগুলি মহীধর স্পর্শ করেন। কাঁপা-হাতে মুছে নেন ধুলো।


৪.


ধুলোবালি ঝাড়তে ঝাড়তে, মহীধর হাঁফিয়ে ওঠেন। ভাবেন, এভাবে আর কতদিন! অকেজো দেয়ালঘড়ি, উলকাঁটা, কাগজের ডাঁই, ফুলদানি, দূরবীন, বাহারি কাচের ঘোড়া—এসব কী-কাজে লাগবে? একদিন কোন কাজে লেগেছিল, সে-কথা ভেবেও, বিস্ময়ের অবধি থাকে না।

মহীধর টের পান, শূন্যতারও আয়তন আছে। এতসব আয়োজন, আসবাব, স্তূপাকার সঞ্চয়ের ভাঁজে, সে কেবল দীর্ঘ হয়, প্রসারিত হয়। ধীরে ধীরে, বদলে ফেলে নিজের আকার। তার গায়ে হাত রেখে, মহীধর চমৎকৃত! দেখেন, দু-হাত জুড়ে, লেগে আছে অন্ধকার, মাকড়সার চটচটে আঠা।

৫.


আজকাল, সন্ধ্যা বড় দেরি করে আসে। সময় পেরিয়ে যায়, তবু আলো কিছুতে নেভে না। চারিদিক, কাঁসার থালার মতো, বহুক্ষণ গমগম করে। মহীধর ছাদে উঠে দেখতে পান পৃথিবীর সীমা। দেখতে পান নিমতলার মাঠ, যেখানে আকাশ খুব নীচু হয়ে, অকস্মাৎ, পৃথিবীর কপাল ছুঁয়েছে। এককোণে, শুশ্রূষার ছায়াটুকু ক্রমশ গভীর হয়, ক্রমশ সজল হয়ে ওঠে।

একটি ফুরিয়ে আসা আখ্যানের পাশে, মহীধর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। মহীধর দেখতে চান, কীভাবে পৃথিবী ফের ডুবে যায়—অন্ধকারে, অন্ধকার জলে।

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments