তুষ্টি ভট্টাচার্য

 

তুষ্টি ভট্টাচার্যের কবিতা




ছায়াপথ


এই সেই ছায়াপথ –
যার শেষ হয়েছে  ব্ল্যাক হোলে।
মাঝের বিস্তারে
কাহিনী অতিক্রম করেছে কাহিনীকে,
পরিব্রাজকের ভূমিকায় কেউ ছিল না
ছিল চলার মত কিছু পড়ে থাকা –
যাকে আমরা মায়া নামে ডাকি। 
   
সেদিন হাওয়া মহলের বাগানে
মহাকাশ থেকে নেমেছিল এক অবয়ব
অসম্ভব ফাঁকা আওয়াজে নিজেকে ঘোষণা করেছিল।
আমিও রেখেছিলাম কিছু গুছনো প্রশ্ন –

কী সেই মহাশক্তি যার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এই ভূমি? যাকে মাটির মত মেখে নিলে কাদা, পড়ে থাকলে ধুলো?
শক্তি কাকে বলে আমি জানি না। আমি জানি হাওয়া সম্বল এই দেহে। শরীর জুড়ে পড়ে আছে বালি আর মাটির ওপর দিয়ে যেতে গিয়ে আমি হোঁচট ভুলে গেছি। বালির শরীরে খানিক তরমুজের ফলন দেখে ফিরে যেতে চাই সেই ভূমির কাছেই। আভূমিপ্রণত হয়ে শ্বাস নিই। মহান সেই শক্তি ফিরে আসে শরীরে। চিনতে পারি না তাকে। চির অচেনার দেশে থাকে বুঝি সে!

রাতের কাছে গেলে আলো খুঁজে পাও? আলোর ঠিকানা সাকিন পেয়েছ এযাবৎ? কোথা থেকে আসে এই আলো, নাকি আঁধার চমকালো?
আলোর কাছেই আলো থাকে বলে জানি। সেই আলোকে দেখি নি এখনও। আঁধার ভেদ করে ছুটে আসে যে কয়েকটি রেখা, বৃত্তের মত জড়িয়ে নিই চোখে, আর তাকেই আলো বলে ভাবি। পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে এনে ভাবি, এই বুঝি আলো! চোখের মণি জুড়ে প্রতিফলনের ছায়া দেখে ভাবি, এই বুঝি আলো! আলো যে আলোতেই থাকে, এটুকু অন্তত বুঝেছি এতদিনে।

অন্ধকার দেখেছ কখনও চোখে? ঘন কালো রাতকে অন্ধকার ভাব? নাকি তীব্র রোদের ভেতরে হেঁটে গেলে অন্ধকার দেখে চোখ?
অন্ধকার আমার ভেতরে থাকে। ফলে আমি ওর মুখোমুখি বসি নি কোনদিন। ওকে অনুভব করি কোন এক কালো রাতে। ওর চেহারা তৈরি করি সেই রাত দিয়ে। জ্যোৎস্না এসে গেলে ফিকে হয়ে আসে ওর আকৃতি। তখন মনে হয়, এমনই বুঝি ও! আধো আলো, আধো ছায়ায় মেশা। তীব্র রোদ আমি সহ্য করি দাঁতে দাঁত চেপে। প্রচন্ড এক মাথাযন্ত্রণার অনুভব চেপে রাখি। কপালের দুপাশের রগ ফুলে গেলে ভাবি, অন্ধকার বুঝি এমনই! চোখ বুজে ফেলি, আর আমি সেই মুহূর্তে অন্ধকারের শরীর হয়ে উঠি। 

শরীর আর মন – দুই কি আলাদা? শরীরের মন নেই? মনের শরীর? আলোর অন্ধকার বা অন্ধকারের আলো?
আমার শরীরে আমার মন থাকে। মনের দেহে শরীরের বাস। একই অঙ্গে কত রূপ দেখি দুজনে, দুজনার। বসন বিনা এ শরীরের ঠাঁই দেয় প্রিয় মাটি, মনের শরীর উড়ে বেড়ায়, অকূল সাগরে ভেসে বেড়ায়, শূন্যে শূন্য বেঁধে দেয় এক অলীক বাঁধনে। আলোরও যে কত রূপ, অন্ধকারের মতই। মন জ্বেলে দেয় আলো, মনই নেভায় এক ফুঁয়ে। শরীরেও আলো জ্বলে। স্পর্শ পেলে বঁধুয়ার। সে জন থাকে এই মনেতেই, এই শরীরেই তার বাস। 

প্রশ্ন ও উত্তরের কাছে
আমি নিজেকে বাজি রেখেছি
হাত ভর্তি শূন্যতা নিয়ে বিজয়ী প্রাণ
খাতার পাতায় উপচে দিয়েছে অক্ষর।
পরাজিত আমি শূন্যের হাত ধরেছি আবার। 
নিয়তির কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছি –
অন্তর থেকে অন্তরে যাওয়ার এই পথ, 
অন্ত হয়ে অন্তে ফেরার এই পথ,
এই সমস্তই পাথেয় আমার।


সত্যকে দেখেছ কখনও? কেমন দেখতে ও? তোমার মত নাকি আমার মত? আর মিথ্যে? তাকে কি কুৎসিত আর কদাকার দেখায়? নাকি সত্যের মত ভালমানুষের মুখ? মিথ্যে বুঝি খুব বজ্জাৎ?
সত্যকে আমি দেখি নি, যেমন দেখি নি মিথ্যেকেও। সত্যকে আমি এতদিন ভেবেছি সেই পুরনো দিনের কাটাকাটা গলার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত। আর মিথ্যেকে ভেবেছি চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা বিকাশ রায়। যদিও ওই দুজনের একজনকেও আমি দেখি নি চোখের সামনে। আমার ভাবনায় আমি যেভাবে সত্যকে এঁকেছি, তোমার ভাবনায় তুমি হয়ত মিথ্যেকেই সেভাবে সত্যি করে এঁকেছ। আমি ভাবি, আমি সত্যের দিকে থাকি, সত্যের পথই আমার একমাত্র সহায়। তুমি ভাব মিথ্যেই আসল সত্যি এ জগতে। আমার সত্য, সে এক অবাস্তব কল্পনা! তুমি আর আমি – দুজনেই ভীষণ সত্য তবু! আর অর্ধ সত্য বা অর্ধ মিথ্যের মত মনে হয় কমল মিত্র অথবা ছবি বিশ্বাসকে। এরা মত বদলায়, পথও। তাই এরাও সত্য ভীষণভাবে।

কল্পনায় আঁকা রেলগাড়ি তো ছোটে না বাস্তবে। লোহার পাতের ওপর যে ছোটে তার কুউউউ যে অতি বাস্তব। যেভাবে বাস্তবের সমস্ত কু-কে এড়াতে পারে না কেউ। কোনটা বেশি সত্য জীবনে, কল্পনা না বাস্তব? স্বপ্ন না স্বপ্নভঙ্গ?
জীবন তো এক কল্পনা। এই আছে, এই নেই। বাস্তবের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের চাষবাস শুরু। সেই ফসলের গন্ধে ম’ম করে আমাদের উঠোন। কল্পনা এক শক্তি যার জোরে স্বপ্ন দেখে মানুষ। যার জোরে বাস্তবের রুক্ষ মাটি খুঁড়ে ফসল ফলায় চাষি। যার গায়ে শ্রমের গন্ধ, আর মনে ধানের রঙ। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বড় বেশি করে বুকে বাজে। ছুরির ফলার মত আমূল বিঁধে যায় হৃদয়ে। আবার এই ক্ষত ভরে দিতে আসে যে, তারও আরেক নাম স্বপ্ন। আরেক নাম কল্পনা। জীবন সত্য, যেমন সত্য কল্পনা। যেমন সত্য স্বপ্ন।

আর সুর? সুরকে দেখেছ? সেও কি বাস্তব? নাকি কল্পনা? স্বপ্নভঙ্গ হলে সুরও কি একদিন হারিয়ে যায়?
সুরকে অনুভব করলেই সুর দেখা দেয়। রক্তমাংসর শরীর নিয়ে সেই দেবী সামনে এসে দাঁড়ান। আর আচ্ছন্ন করে দিয়ে যান চারপাশ। সুর কল্পনা নয়, স্বপ্নও নয়। সুর হারায় না, থেকে যায়। দিক হারায় মানুষের মন। আর সুরকে খুঁজে না পেয়ে ভাবে, সুর এক অবাস্তব। সুর খুব অভিমানী, একটু চোট-আঘাত পেলেই দূরে সরে থাকে। তাকে তখন সুরে সুরে বাজাতে হয়। যে জানে টঙ্কার, সেই সুরকে পায়। বীণা বেজে ওঠে তখনই যখন তা থাকে বীণাপানির কাছে। মন রে, বীণাপানি হয় ওঠ্‌ এবার। বেজে চল্‌ আদিঅনন্ত কাল ধরে, সুরে সুরে... সুর আর মন দুইই অক্ষয়, অমর।


সেদিন আর ফেরে না
অতীত খুঁড়েছে নিজের কবর নিজেই। 
তবু বেলা আসে দিনের ভেতর
এ দীনের হাত ধরে থাকে
আমার সেই আমিই।
মেঘলা দিনের শেষে
দিগন্ত হেসে উঠলেই রঙধনু
রঙের বাটি উল্টে
গান ধরি...

তুমি কি বর্ণচোরা? নাকি রঙিন মাতাল এক? রঙ মিলান্তির খেলা জান?
আমি তো আমিই। আমার মধ্যে বাস করে লক্ষ আমি। কেউ রঙ হারায়, কেউ রঙ ফিরে পায়, কেউ বা রঙের বাটিতে ডুব সাঁতার দেয়, কেউ আবার সেই বাটিটাই উল্টে দেয়। কখনও রঙিন আমি, কখনও ফিকে, কখনও বা বর্ণচোরা। এই সবগুলো আমি মিলে যে আমাকে পাই, সেই রঙ মিলান্তির খেলা শেখার চেষ্টা করে। শেখে আবার ভুলে যায়, আবার চেষ্টা করে, আবার ভোলে... আসলে আমরা এইভাবেই কখনও বর্ণচোরা, কখনও রঙিন মাতাল। রঙিনের বেরঙিন হতে যতটুকু সময় লাগে, বেরঙিনের রঙিন হতেও তাই। মিলিয়ে দেওয়ার খেলাটাই সার।

জীবন না মৃত্যু, কে বেশি মাহাত্ম্য আনে? জীবন কি মৃত্যুর চেয়েও অধিক সহনশীল? মৃত্যু কি অসহ্য জীবনের অগতির গতি?
এই দেহে প্রাণ আছে বলেই আমি জীবিত। আমার নিঃশ্বাসে জীবনের বীজ লুকিয়ে। জীবনকে অস্বীকার করার উপায় নেই কোন। প্রাণহীন শরীর মৃত্যুর অধীন। তার সঙ্গে জীবনের সম্পর্কের সেখানেই শেষ, কিছুক্ষণের স্মৃতি চিহ্ন ছাড়া তার আর কোন ভূমিকাই নেই। এমনও জীবন আছে, নড়েচড়ে, কথা বলে, শ্বাস নেয়, তবু যেন জীবিত হয়েও সে মৃত। সেই প্রাণবায়ুতে নেই অনুরণনের ধার, তাই কি সে মৃতেরও অধিক মৃত? যন্ত্রের মত হাত-পা-মাথা যার, তাকে কি জীবন্ত মানুষ বলতে পারি? এমনও তো হতে পারে, এক সামান্য ফুলের গন্ধ, এক সাধারণ গানের ঝলক, এক শিশুর হাসিতে সেই যন্ত্র সত্যিকারের প্রাণ ফিরে পেল। মূর্তির আগল ভেঙে সে তখন রক্তমাংসর মানুষ। এই সেই জীবন, যে পায় সেই জানে। আর সেই ছিল মরণ, যার মৃত্যু ঘটেছিল, সেও জানে। যে যত সহনশীল, সেই তত বেশি উপভোগে সক্ষম, সে জীবনই হোক বা মৃত্যু। বৃক্ষের মত সহনশীলতাই জীবন। এক সামান্য ঝড়ে শেকড় উপড়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হলে, সেই বৃক্ষ বৃক্ষই নয়।


7 comments:

  1. বেশ ভালো লেখা। মাঝে মাঝে তুমি বেশ দার্শনিক হয়ে যাও। মায়াতত্ত্ব লেখো। দারুণ লাগে। এটাও দারুণ লাগল। ছায়াপথ ধরে কিছুটা হেঁটে গেলাম মনে হল।

    ReplyDelete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. দারুণ লাগলো গো।একস্তর থেকে বহুস্তরে আচমন ঘটলো।

    ReplyDelete

Facebook Comments