শাশ্বতী সান্যাল

 

শাশ্বতী সান্যালের কবিতা

 

সামুদ্রিক উপকথা

১.
নোনতা বালির গর্ত থেকে যারা একদিন উঠে এসেছিলো, আমরা তাদেরই দলে। যদিও তখন তোমার গায়ে ছিল ভেজা শ্যাওলার প্রলেপ আর আমার শরীরে খাঁটি আর্য রক্ত। আমার সমুদ্রসম্ভব ইচ্ছের বদলে তোমার অনেক বেশী পছন্দ ছিল জলমগ্ন ভেজা কন্দর...

যে পৃথিবীতে পরপর তিনটে বড়সড় যুদ্ধ হয়ে গেছে, তার জলসীমা বেড়ে তো যাবেই। গভীর বিপদরেখা এঁকে রাখবে ধূর্ত জেলেটি। দুএকটা বাচ্চা ছেলে নেহাত কৌতুকবশে বন্ধ করে দেবে বাতাসের যাতায়াত...

যারা বুঝিয়েছে আমরা বন্ধু নই। আমাদের গাত্রবর্ণ, খাদ্যাভ্যাস, স্বপ্ন সমস্ত আলাদা -  আদতে কেউই তারা সমুদ্র দেখেনি।  ফলত: জানেনা, জল সরে গেলে ডুবেযাওয়া শ্বাসমূল উঠে আসবে প্রতীকের মতো। আমরাও শেষরাতে পুরোনো গল্পের রেশ ধরে আস্তানায় ফিরে যাবো, শুয়ে পড়ব পাশাপাশি,  একই বিছানায়...

২.
জলের মধ্যে দিয়ে একটা কম্পাঙ্ক টের পাওয়া যেত। খুব বেশী না, ৮৩৪ হার্জ। পায়ুপাখনায় লেগে থাকতো অবসেশন।

এদিকে নাব্যতা কম। নি:সঙ্গ নুন আর ফাঙ্গাস লেগে আছে এলবামে, প্রবালপ্রাচীরে। পূর্ববর্তীদের লালা বা পেচ্ছাপের গন্ধ খুঁজে পাইনি। শুধু ভাঙা গ্লেসিয়াসের টুকরো...

আমার শরীর খারাপ করছে।

ঋতুবন্ধের দিনে কিছু শব্দ  অনুসরণ করে একটা উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌছনো যায়। এরোড্রামকে তাচ্ছিল্য করে বারদুয়েক মুখ তোলা যায় আকাশের দিকে। যতক্ষণ না পুরোনো কম্পাঙ্ক ফিরে আসে, ততক্ষণ আমিও প্রেমিকা

তুমি নেতা। দলপতি। প্রাক্তন প্রেমিক।

৩.

কালো আঁটোসাঁটো হাতে সাদা শাঁখাগাছি বেশ শক্ত হয়ে চেপে বসেছিল। শেষ অব্দি নুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলতে হল।

 যে ঘাটে সে চানে যাবে, অলুক্ষুনে ডিঙিটাকে, মাথা খাও, সে ঘাটে বেঁধোনা। ছ'মাস পোয়াতি। কেউ ধরে রেখো, থলিভর্তি ডিম ভেসে যেতে পারে কুসুম কুসুম ঘন স্রোতে...

তারপর সে, সপ্তডিঙা মধুকর বেয়ে যদি কখনো না ফিরে আসে...

জেলেদের বস্তিতে কান্নার রোল উঠলে মাছের মেয়েটি দুটো রাত বড় আরামে ঘুমোবে...



দাঁড়কাক



না, আমার কোনো পোষা দাঁড়কাক নেই
তাদের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিলো সাতাশ বছর আগে
যে মানুষটা আমাকে সাদা দাঁড়কাক দেখানোর গল্প বলেছিলো
খুব মনে করে দেখলাম, তার নাম নাদের আলি নয়

অর্থাৎ বলা যায়, আমি এবং দাঁড়কাক
অথবা, দাঁড়কাক এবং আমি
দীর্ঘদিন পরস্পরের প্রতি সৌজন্যমূলক দূরত্ব বজায় রেখেছি...

এখন সমস্যা হল, ইদানিং আমি একটা বহুতলে বাস করছি
না না, বহুতল সমস্যা নয়
সমস্যা হল, তার জানালাটা
ওটা খুললেই একটা ভাঙা পাঁচিল দেখা যাচ্ছে
তার নীচের রোদ্দুরে কালো কালো কিছু প্রাণী
ঘাড় নিচু করে বসে থাকে...
দাঁড়কাক নয়, মানুষ।
নিজেদের পিন্ড হাতে নিয়ে ওরা বসে থাকে
কোনো এক শুভক্ষণে, আকাশ থেকে পাক খেয়ে
একটা অলৌকিক দাঁড়কাক নেমে আসবে বলে

অথচ আপনি তো জানেন স্যার
দাঁড়কাক এক লুপ্তপ্রায় প্রজাতির নাম
পড়ার টেবিলের পাশের আয়নায় ছাড়া
আমরা সাতাশ বছর দাঁড়কাক দেখিনি

তাই পেটের ভিতর হাত ঢুকিয়ে
নিজেদের পিন্ড ক্রমশ নিজেরাই গিলে নিচ্ছি...

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments