দেবাঞ্জন দাস


দেবাঞ্জন দাসের গদ্য


বাজার যেভাবে কবিতা হল




      এক পা, দু পা করে হাঁটতে হাঁটতে যখন বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা এবং ক্রমশ বাজার এসে উপস্থিত হয় তখন হঠাৎ করেই এক নতুন দুনিয়া শুরু হয় যেন। পাখি পুষতে গিয়ে শুরুতে অলোক এ’কথা ভাবেনি। ছোটবেলায় বাবার সাথে বাজার করতে যাবে। ঐ হাট, পসারিণী, রক্ত চোঁয়ানো কাটা ছাগল, হলুদ আলোর মফস্বল তাকে অন্যতর ঠিকানা দিত। পাখিদের নাকি ঠিকানা নেই ? এ’কথা ভাবতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে— এ আসলে আকাশকে মহৎ করার পরিকল্পনা। যে আকাশে পাখি ওড়ে না, সে ক্রমশ ছোট হয়ে যায়। যে ঝিঙ্গে, পটল রোজই ঝুড়ি থেকে বেরোচ্ছে এবং রান্না হচ্ছে তাকে দোকানীর ঝাঁকাতে অন্যরকম লাগে। পাখিগুলো একটু একটু করে বড় হল। ওদের দৈনন্দিন খাওয়ার, জল, খাঁচা পরিষ্কার করতে করতে অলোকের কাছে একসময় খাঁচার অস্তিত্বটাই হারিয়ে গেল। হ্যাঁ রে .. পাখিকে খাঁচায় আটকে পুষছিস ?! অলোক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত .. কোথায় খাঁচা?! এভাবে অলোকের বাস্তবে পাখি, খাঁচা প্রোথিত হল। এখন সে এক উপস্থাপিত বাস্তবের অলোক। অলোক কোনদিন সূর্যাস্ত শাসন করতে পারবে না। পাখিও কোনদিন আঙ্গুলে দুব্বো ঘাসের বীজে সমস্ত আনন্দকে জড়ো করতে পারবে না।

      খাসির মাংস ছেড়ে যে অসমর্থ স্নেহ বেশি করে মুরগীর মাংস কেনে তার প্রজাপতি ঢেঁকি শাকের আগায় অনেকক্ষণ ঘুর ঘুর করে। পাশের বউটি চলেছে ঘোমটা দিয়ে। বারবার বললেও কলমি হেলেঞ্চা সহজে কেনা হত না। খাওয়ার পাতে সেই অসমর্থ স্নেহ এমনি এমনিই দীর্ঘ হয় বিকেলের খেয়ালী দৌড়ের মত। আমার হাঁটার সাথে দুনিয়া বদলায়, অলোকের পাখির সাথে অলোক। একেই তো আমরা নানা নামে ডাকি— শ্রমিক, মালিক, নোয়াপাতি, আপোষকামী, সুবিধাবাদী ... এদের বাস্তব এদের ঘিরেই গল্প বলতে থাকে। এক জায়গায় এলে জাদু বাস্তব। ওভারল্যাপ আর ছাপিয়ে যাওয়ার গান বাজতে থাকে কানে কানে।
 
    সেই বহমানতাই বাবার হাত ছাড়িয়ে বাজারকে একা করে। একাধারে নিজেরও। এভাবেই এ্যালিয়েনেশন প্রিয়তম নিকট হয় মানুষের। সেখানে মাংসের কাঁপন স্তনোত্তীর্ণ ছন্দকে ইঙ্গিত করে। পাখিগুলো খাঁচার বাস্তব মুখে উড়ছে ... তৈরি হচ্ছে অলোকের বাস্তব। এই সামগ্রিকতাকে উপলব্ধি করাই জীবন, তাই সেখানে নিবেদিত হতে হয়—

 
এক বারান্দা দৌড়
শব্দ হতে বসেছে গ্রাসে গ্রাসে
স্বপ্নের ভাত হবে
তথাপি সতর্ক পাহারা
এবার ডাকাতির কথা 
বলব উনুনের মাংসেরা কেমন করে গান হল
পৈতে খোলার দিন এসেছে 
আজ সব মাংসই বাজছে, কাঁপছে মৃদু    
দিনের শেষটাকে সূর্যাস্তই কোরো প্রভু
একটু চাঁদ ছুঁইয়ে দিয়ো
যদি জীবনের কথা বল, আঙ্গুল থেকে রঙ মাখতে মাখতে
ভাতগুলো পৃথিবীর রূপকথা হয়েছে... 
জমির আলপথ বেয়ে নামি  
চোখকে মৃদু ধমকাই— ওরে তোর বয়স বাড়ছে
বিজনকে আঁখিপল্লব দিলি
আর বাচ্চাদের শিস লেগে নরম হল বাঘের গল্পরা ...


      মাছ বাছতে বসেছে ঠাকুমা। কুচো মাছ, বেগুন আর কলমি দিয়ে তরকারি হবে। কলমির আঁটিতে কিছু গিমে, কিছু দুব্বো ... বাছা শেষ করে বাঁশের ঝুড়ির উল্টোদিকে মাছগুলোকে ঘষা হবে। হালকা পেটটা টিপে পিত্তি বের করা হবে। স্বপনদা লিখেছিল ‘মত মাছ ঔরলা’। ‘মৌরলা’-তে পৌঁছে পাঠকের তৃপ্তি কবির সাথে এক দীর্ঘ ইন্টার‍্যাকশন তৈরি করে। আমরা সাজাতে সাজাতেই চলি জীবনভোর বা ভাঙ্গা সাজাতে সাজাতে। তাই কবিতার ইতিহাস যেমন ফর্মের ইতিহাস তেমনই ইতিহাসবিস্মৃত আধুনিকতার মৌতাতে আমরা ভেঙ্গে ফেলি ইমারত। রক্ত-মাংস থেকে দূরে চলে এসে নিজেকে নরম করি বাঘের গল্পে ...
 
      গল্প থেকে গল্প এগোতে থাকে। ধ্রুপদী শিল্পের কাড়া-নাকাড়া যেমন করে পপ-আর্ট হয়ে উঠল। তুমি, তোমার গেরস্থালী, অসাবধানী স্নেহ, মাইকের ঘষাপিটা প্রতিবাদ আর ব্যাঙের নির্লজ্জ একঘেয়েমি তোমাকে যে অনাবিল কেওসটি দিল। সেই কেওস থেকে, আবর্তিত বাস্তব থেকে সরে যাওয়া কেবলমাত্র ধ্বনিময় নয় বরং এক ইঙ্গিতময় রূপকথার দিকে। তার মাংস তোমাকে নক করে, আঁখিপল্লব খোলে বিস্মৃতির দুয়ার ... তৈরি হচ্ছে অলোক, বিজনদের বাস্তবতা ...    

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments