মলয় রায়চৌধুরী

 

নীলিমা দেব 

মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার


নীলিমা : ‘মুদ্রিত পত্রিকা’ ও ‘ওয়েব পত্রিকা’ এ-দুটো বিষয়কে আপনি কিভাবে দেখেন ?

মলয় : বাংলা ভাষাসাহিত্যে আপাতত দুটোরই প্রয়োজন রয়েছে, তার কারণ লিটল ম্যাগাজিনগুলো প্রথমত গোষ্ঠীবদ্ধ, দ্বিতীয়ত একটা লিটল ম্যাগাজিন পাঁচশো কপির বেশি ছাপা হয় না বলে তার পাঠক সংখ্যা সীমিত, তৃতীয়ত পত্রিকাগুলো একটা বিশেষ ভৌ্গলিক এলাকায় আটক থেকে যায় । কিন্তু মুদ্রিত পত্রিকাগুলো গবেষকদের সাহায্য করে, সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরিতে গিয়ে গবেষকরা কোনো বিষয়ে প্রয়োজনীয় লেখাগুলো এক জায়গায় পেয়ে যান, ‘ওয়েব পত্রিকা’র ক্ষেত্রে তাঁদের গুগল খুঁজে-খুঁজে বের করতে হবে, প্রিন্ট আউট নিতে হবে, তাতে অনেক সময় নষ্ট হবে তাঁদের । কিন্তু ওয়েব পত্রিকার সুবিধা হলো যা তা সারা পৃথিবীর পাঠক পড়তে পারেন, লেখালিখির ক্ষেত্রেও তাতে গোষ্ঠীবদ্ধতা কম ।

নীলিমা : আজকাল বাংলা কবিতায় অন্য ভাষার শব্দযাপন নিয়ে আপনার কি মত ?

মলয় : ইংরেজি কবিতায় বহুকাল থেকে লাতিন, ফরাসি, গ্রিক শব্দ ব্যবহার করা হয় । সে কবিতাগুলো পড়ার সময়ে আমাদের অভিধানের সাহায্য নিতে হয়েছে, ছাত্রাবস্হায় অধ্যাপকদের কাছ থেকে মানে জেনে নিতে হয়েছে। বাংলা কবিতায় অন্য ভাষার শব্দ এইজন্যে আসছে যে প্রতিদিনের কথাবার্তায় কবিরা তা নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করছেন । প্রচুর বাংলা শব্দ আছে যা ফারসি আর আরবি থেকে এসেছে । আবার অনেক শব্দ এমন যেগুলো ইংরেজি বা ফরাসি শব্দকে অনুবাদ করে তৈরি করা, যেমন সিমবল শব্দের বাংলা প্রতীক, অরিজিনালের বাংলা মৌলিক --- এই শব্দগুলো হরিচরণের শব্দকোষে পাওয়া যাবে না । জীবনানন্দ ইংরেজি শব্দের অনুবাদ নিজের মতন করে বাংলা করে নিয়েছেন, যেমন আকাশলীনা । বাংলা অভিধানে দেখবে বহু বাংলা শব্দের মানে বোঝানো হয়েছে ইংরেজি শব্দের মাধ্যমে । একই সঙ্গে কথোপকথনের বহু শব্দ হারিয়ে গেছে, ‘কলিকাতা কমলালয়’ পড়লে টের পাবে সেখানে অজস্র শব্দ রয়েছে যা আর প্রয়োগ হয় না ।




নীলিমা : শঙ্খ ঘোষকে জ্ঞানপীঠ দেওয়া হলো । আপনার মতে কি সঠিক কবি ও সঠিক কবিতাকে সমর্থন করা হলো ?
মলয় : পুরস্কারগুলো তো বুড়ো না হলে দেয়া হয় না । বাঙালি কবি-লেখকদের মধ্যে উনিই বয়স্ক, তাই ঠিক-বেঠিকের প্রশ্ন ওঠে না । বিনয় মজুমদার যখন মৃত্যু শয্যায় তখন তাঁর শিমুলপুরের বাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্র পুরস্কার আর অকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ।

নীলিমা : দেশে নানা রকমের শিল্পী ইনটলারেন্স নিয়ে চিন্তিত । অ্যাও্য়ার্ডও ফিরিয়ে দিচ্ছেন । ইনটলারেন্স নিয়ে আপনার কি মতামত ? অ্যাওয়ার্ড ফিরিয়ে দেওয়া নিয়েই বা আপনার মতামত কী ?

মলয় : ইনটলারেন্স সঞ্জয় গান্ধির সময়ে ছিল, লালু যাদবের বিহারে ছিল, সিপিএমের পশ্চিমবাংলায় ছিল, তৃণমূলের কার্টুন-বিরোধীতায় ছিল, পাঞ্জাবে গিলের সময়ে ছিল, আসামে বঙ্গাল খেদাওতে ছিল । সেই ঘটনাগুলোর সঙ্গে এখনকার ইনটলারেন্সের পার্থক্য হলো এখন ব্যাপারটা হিন্দুত্ববাদী বিজেপির চাপিয়ে দেওয়া। এটা নতুন ধরণের রাজনৈতিক চাপ যা আমরা আগে দেখিনি । যাঁরা অ্যাওয়ার্ড ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই বামপন্হী মতামতের ।  লালু যাদবের গুণ্ডাদের সময়ে, সিপিএমের বিরোধী-নিধনের সময়ে, বঙ্গাল খেদাওয়ের সময়ে ফিরিয়ে দেননি । অ্যাওয়ার্ড ফিরিয়ে দিয়ে শিল্পীরা নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ করার প্রয়াস করেছিলেন । আমাকে অনুবাদের জন্য সাহিত্য অকাদেমি যে পুরস্কার দিয়েছিল তা আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলুম, কারণ আমি নীতিগতভাবে কোনো পুরস্কার নিই না, লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কারও নয় ; প্রতিটি পুরস্কারের সঙ্গে পুরস্কারদাতার মূল্যবোধও চাপিয়ে দেয়া হয়, নয়তো তৃণমূল এসেই বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে সিপিএমের বাছাই করা সদস্যদের ভাগিয়ে দেবে কেন ? তাঁরা তো জ্ঞানীগুণী লেখক-অধ্যাপক ছিলেন ।

নীলিমা : আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কতোদূর ? আপনার মতে এখন বাংলা কবিতার ট্রেণ্ড কী? কোথায় যাচ্ছে এই কবিতা । কোনো নতুন হাংরি আন্দোলন কি অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাচ্ছেন ?

মলয় : বাংলা ভাষায় যে ধরণের কবিতা লেখা হচ্ছে তাকে আন্তর্জাতিক স্তরেরই বলা যায় । দুর্ভাগ্যবশত বাংলা থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করার মতো লোক নেই । প্রাইমারি স্তরে ইংরেজি শেখানো বন্ধ করে পশ্চিমবাংলায় একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা ইংরেজি-ইল্লিটারেট । তবে ইউরোপীয় ভাষাগুলোয় আর অন্ত্যমিলের বা ছন্দের কবিতা প্রায় লেখাই হয় না ; তাই বাংলায় যাঁরা মিল দিয়ে কবিতা লেখেন তাঁদের কবিতা ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করলে সেকেলে মনে করবে পাঠক-পাঠিকারা । টাইমস লিটেরারি সাপলিমেন্ট, প্যারিস রিভিউ, পোয়েট্রি ম্যাগাজিন, লণ্ডন ম্যাগাজিনে কিন্তু বাঙালি কবিদের কবিতা প্রকাশিত হয়, তাঁরা সরাসরি ইংরেজিতে লেখেন বলে । হাংরি আন্দোলন ছিল একটা বিশেষ সময়ের প্রডাক্ট । আর অমন আন্দোলন সম্ভব নয় ।

নীলিমা : মহিলা কবিদের কবিতাকে আপনি ঠিক কীভাবে মূল্যায়ন করেন ?

মলয় : মহিলা বলে তো আর তাঁদের কবিতার জন্য কোনো আলাদা মানদণ্ড নেই । নারীবাদীদের কবিতা ছাড়া, কবির  নামটা সরিয়ে দিলে টের পাওয়া যায় না তা মহিলার লেখা কিনা । তবে তরুণীরা আজকাল অসাধারণ কবিতা লিখছেন, যেমন যশোধরা, মিতুল, তানিয়া, বিদিশা, জয়িতা, স্বাগতা, জপমালা, দেবযানী প্রমুখের নাম করা যায় ।

নীলিমা : গদ্য, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কোনটা আজকের দিনে আপনাকে বেশি স্পর্শ করছে ? কেনই বা ?
মলয় : এখন বয়সের কারণে পড়াশুনায় সময় দিতে পারি না । তার ওপর আঙুলে আরথারাইটিসের কারণে নিজের লেখা লিখতেই প্রচুর সময় যায় । শেষ যে উপন্যাস পড়েছিলুম তা নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট । কবিতার বই অনেকেই পাঠান, কিন্তু সেভাবে একাগ্র হতে পারি না । বেশিক্ষণ বসে থাকতেও আজকাল অসুবিধা হয় । শুয়ে পড়তে-পড়তে ঘুম পেয়ে যায় ।

নীলিমা : হাংরি আন্দোলন করলেন, কবিতা লিখলেন, উপন্যাস লিখলেন । কি-কি রয়ে গেলো যা আগামী দশ বছরে আপনি করতে চান ?

মলয় : নাটক, কাব্যনাট্য, ডিটেকটিভ উপন্যাস, ছোটো গল্পও লিখেছি । দশ বছর বাঁচবো না । দু’তিন বছর আর বাঁচবো বলে মনে হয়। স্বাস্হ্যের যা অবস্হা, তাও বাঁচবো কিনা ঠিক নেই । দুটো বই লেখার ইচ্ছে আছে । একটা রান্নার রেসিপির বই, যা থেকে বোঝা যাবে যে মায়ের আর স্ত্রীর কাছ থেকে ভালো রাঁধতে শিখেছি । অন্য বইটা কলকাতা নিয়ে। হাংরি আন্দোলনের ইনভেস্টিগেশনের সময়ে মাঝে-মাঝে লালবাজারে যেতে হতো । ফালতু বসে আছি দেখে দিনের বেলা আর রাতের বেলা পুলিশ অফিসাররা আমাকে ওনাদের ভ্যানে বসিয়ে কলকাতার আনডারবেলি দেখাতে নিয়ে যেতেন । দেখি পারি কিনা লিখতে, কেননা স্মৃতি ধ্যাবড়া হয়ে গেছে, কলকাতা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

8 comments:

  1. মলয় দা যেন কাজ শেষ করতে পারেন.

    ReplyDelete
  2. বেশ ভালো লাগলো।।

    ReplyDelete
  3. খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete
  4. দারুণ দাদা।কলকাতা নিয়ে লেখার চিন্তা কদিন আগে স্ট্যাটাসে দিয়েছিলেন।অপেক্ষায় আছি

    ReplyDelete
  5. একজন সঠিক মানুষের সঠিক সাক্ষাত্কার

    ReplyDelete
  6. ছোটোর মধ্যে খুবই ভালো সাক্ষাৎকার ।

    ReplyDelete

Facebook Comments