দেবযানী বসু


কবি দীপঙ্কর নিজেই নিজের তুলনা


নিওলিথ জোছনার পর একটা প্রিক্যাম্বিয়ান রাত এর সন্ধান পেলাম।অমেরুদন্ডী সমাজকে ব্যঙ্গের কশাঘাত করতে প্রায় ছশ মিলিয়ন বছর আগেকার জীবনকে এখনকার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হয়,যাচাই ও তুলনা করতে হয়।  আশির দশকের কবি দীপঙ্কর দত্তকে বিশেষত তার কবিতা নিয়ে দুকথা বলার অক্ষম চেষ্টায় একমাত্র  সাপোর্টিভ অক্সিজেনের নল যা কিনা অজিত রায় কৃত মুখবন্ধ যেটা অকালমন্দ কি তালা খুলে দিচ্ছে , মুখবন্ধ টি ' দীপঙ্কর দত্তর কবিতা ' বইটির লাগোয়া একটি ক্লিনিকাল রিপোর্ট। জিরো আওয়ার পাওয়ার পোয়েট্রি ম্যাগাজিনের কবি দীপঙ্কর দত্তকে পোস্টমডার্ন ভাবধারার কবি বলা যায়।


হাংরিয়ালিস্ট মলয় রায় চৌধুরির ভাবধারায়-ও স্নাত ছিলেন দীপঙ্কর। আশির দশকটা ছিল কবিতার ভাঙ্গাগড়ায় উজ্জল।ওই সময়ে ধামাধরা ধারাবাহিক কবিতা থেকে দূরে সরে ব্যক্তিত্বপূর্ণ নিজস্ব লেখনশৈলী তৈরি করা বেশ সংগ্রামযোগ্য ব্যাপার ছিল।'আগ্নেয় বসন্তের জাগলার ' কবিতার শেষাংশটুকু তুলে দিলে চলতি আজ কাল পরশুর বঙ্গীয় রাজনৈতিক অবস্থানটাকে চিনে নিতে সুবিধা হবে।বিধায়ক সাংসদদের মুখগুলো মনে পড়বে।সংলাপগুলো মনে পড়বে।'অ্যাম সরি জানি একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে, কিন্তু স্যর,উস্কানিটা আমি এভাবেই দেই এবং দেবো কারণ আঘাৎ বলতে বুঝি

' Death blow, Coup de grace. বাড়িতে হানা দিন , মা-ঝি ফেঁড়ে যান, বাবাকে থাপ্পড় রাস্তায় ম্যাটাডর থেঁৎলে যা  এক পা দুসরা পায়ে অপাহিজ দেওতা-'


দূর্বোধ্যতার দোহাই দিয়ে তাঁর কবিতাকে দূরে সরিয়ে রাখলে পাঠক মূল্যবান কিছু হারাবে।দিল্লি হাটার্স পত্রিকার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন আজীবন।নিম সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম রবীন্দ্র গুহ দিল্লি হাটার্স পত্রিকার কর্ণধার।ইংরাজি বাংলা  হিন্দি পান্জাবি চার ভাষাতেই তুখোড় ছিলেন খুব।তাঁর কাব্য পড়লে মনে হবে অত্যাচারিতের সঙ্গে অত্যাচারীর সম্পর্ক অনেকটাই জায়গা নিয়েছে।প্রতিটি কবিতায় আছে সিনেমাটিক প্রজেকশন,বৈদেশিক সিনেমা গল্প গানের চরিত্রদের দ্রুত চলমান ছবি ,ফুল অব অ্যাকশন,আলোআঁধারি কল্পচিত্রময়তা। 'স্ট্রিং ' কবিতায় দেখছি ভিন্নস্বাদের এক অনুভব -

'গানের এক একটা ঘূর্ণি হল্কা আসে
মাটিতে দাগড়া ঘোড় ক্ষুর দেগে
মনে করিয়ে যায় দুজন ড্রামারের কথা
যারা নেশায় ধুঁকছে
রবার্ট আর ম্যাকমিলান'



'যাই ওঠ শালা
জল ছিটে দোবো
টেনে থাপ্পড় কশাবো নাকি মুখে
কোরাল কার্ফিউ ফেড়ে ড্রামে ঘা দে
অর্গ্যান ছিদ্রে কেন্নোর লাখ পা-র চলাচল লু'    

কবি শুধু মঞ্চ পরিচালনার করতে করতে লিখে ফেলছেন কবিতা ঝড়ের গতিতে।তাঁর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার,অধীত বিদ্যার জগৎ কবিতায় চিহ্ন ফেলে যাচ্ছে - শ্যাগি ডগ স্টোরি,আবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেসনিস্ট চিত্রকর জ্যাকসন পোলক, আর্শাইল গোর্কির ছবি দ্য লিভার ইজ দা কক'স কোম , সুররিয়ালিস্ট আভান্ত-গার্দে চিত্রকর জুলিয়ান লেভি,রেইল রোড হাংগার গোষ্ঠির লিরিকস, সংগীত, ইজিপসিয়ান হায়ারোগ্রাফিকসের জিয়ান ফ্রান্কোর উল্লেখ ইত্যাদি। কবির কবিতার রঙ্গমঞ্চের কুশীলবরা  খুনি জোচ্চোর কৃতদাস দুখিচাষি ক্যাটসোয়াক পারদর্শিনীরা হাড়হাবাতে ও লাস্য ও অভিজাত বেশ্যারা।



উচ্চবিত্তর বেশ্যানিয়ন্ত্রিত বিলাসী জীবন ভ্রষ্টাচার তার মধ্যে কবি তার শানিত কলম আর প্রখর বোধ নিয়ে 'ভাঙ্গা চতুষ্পাঠি জুড়ে আমি একাকী পিশাচ' হয়ে ভ্রাম্যমান।কোথাও খুঁজে পাই মাধুর্যের বিন্যাস,কোমলতার উচ্চারণ 'ভুখাল্যাংঠাকে দাওয়ায় ঘটিজল মেথি পরোটার আচারী লপেট দিয়েছিল অষ্টমাতৃকার এক সালকিয়ার বিদিশা বিশ্বাস' এখনো নেট খুললে পাওয়ার পোয়েট্রি খুঁজে পাব।বিভিন্ন ভাষার ককটেল সযুক্তি, তার রসময় প্রয়োগ কবির সংগ্রামী হিরোয়িক মেজাজ পাঠক তার কবিতাময় অহংটিকে চিনে নেয়। কিছু উল্লেখযোগ্য পঙ্ক্তি তুলে দেবার লোভ সামলানো গেল না -



১। তারার আলো থাকতে কাকভোরভোর যে বর্গীরা বেরুবেন
২। লাল লাল ঝাল একটা চচ্চড়ির কশাননা পূবাকাশ
৩। জল থেকে ক্রিস্টাল গীটার গা-ঝাড়া/ স্টিল স্ট্রিং স্টিল নোখের খামচি ধুনারি এই পপ
৪। আগুন ছড়াতে থাকে/হাতের বাইরে চলে যায় আগুন
৫। ছ ঘন্টার ব্লাড ট্রান্সফিউসন আর ড্রিপ অক্সিটোসিন মৃত বাচ্চাটির ওজন প্রায় ছয় পাউন্ড   ইয়েস দুধ  টানছে--
৬। চোখগুলি উপড়ে ধুয়ে জামরুলের মতো
৭। হোলহুয়ীট টোস্ট শ্রেডেড চিকেনের তরে আজ-ও মহীনেরা চরে।
৮। ব্যানানা ফ্লেভার্ড কন্ডোমগুলির কতোটা ফুডভ্যালু জানিনা
৯।  হুকুম চোদ্দবছর পর ভ্যালিতে রোদ এল রজঃদর্শন।আর কি ফ্লো!



কথোপকথন ও স্বগতোক্তি সমৃদ্ধ কাব্যের চলনরীতি গল্পরসের ছিঁটে লাগানো আদবকায়দা পাঠককে হান্ট করে তাড়িয়ে নিয়ে যায় এক জগৎ থেকে অন্য জগতে। সম্প্রতি কবি দীপঙ্কর দত্ত শূন্যকাল আন্তর্জাল পত্রিকা সম্পাদনা করছিলেন।পত্রিকাটি প্রবীণ ও নবীন কবিদের অন্যমাত্রিক কবিতা ছবি গল্প প্রবন্ধে উৎসবময় হয়ে উঠছিল।কবিকণ্ঠে কবিতা, কথোপচারণ, কাব্যডায়েরী, কাব্যানালিসিস,ভিসুয়াল পোয়েট্রি 'ইত্যাদি নানা বিষয়ের সাহিত্য চর্চা চলছিল।এর মধ্যে কাব্যডায়েরি নামের একটি স্বতন্ত্র ও অভূতপূর্ব কবিতা বিভাগ ওনার মস্তিষ্কপ্রসূত।


এবং এই ধরণের কবিতাবিন্যাস যথেষ্ট বিতর্কের অবতারণ করেছিল ফেসবুকের কবিদের মধ্যে।কবি দীপঙ্করের কবিতা খুব ভালো যে আত্মস্থ করতে পেরেছি তা নয়, আমার ভাষাজ্ঞান সীমিত।কিছুটা আস্বাদন করেছি।আদ্যন্ত নাগরিক এই কবির মুন্সিয়ানায় জাদুগ্রস্ত হয়ে আছি।একরোখা এই কবির কাব্যরচনায় আরো নতুন কোনো পরিবর্তন  আসত কিন্তু তাঁর অকস্মাৎ বিদায়ে শোকস্তব্ধ হয়ে আছি।

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments